দেশের মুরগি, ডিম ও পোলট্রি খাবারের বাজার জিম্মি করে রেখেছে বাণিজ্যিক উৎপাদক বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো। এদের মধ্যে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি ও সিপি বাংলাদেশ নিজেদের ইচ্ছামতো সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করে লুটে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফা। যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে সিপি বাংলাদেশকে বিপুল অঙ্কের জরিমানাও গুনতে হয়েছে। জানা গেছে, ডিম, মুরগি ও পোলট্রি খাবার বাজারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজী ফার্মসের নাম উঠেছে একটি দূতাবাসের জরিপেও।
বাংলাদেশের পোলট্রি খাতে করপোরেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গবেষণা করেছে ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রয়লার মুরগির গ্রান্ড প্যারেন্ট স্টক (জিপি) বাজারের ৮৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে দেশের শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির হাতে। মাংসের জন্য পালনকৃত ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার মজুত সবচেয়ে বেশি রয়েছে কাজী ফার্মস গ্রুপের। দুটি খামারে তাদের ৪৯ হাজার ব্রয়লার জিপি স্টক রয়েছে।
কাজী ফার্মসের দখলে ব্রয়লারের জিপির বাজারের ৩৪ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটির ব্রয়লার ও লেয়ারের পিএস খামার রয়েছে সাতটি। যেগুলো এক দিন বয়সী বাচ্চা উৎপাদন করছে। কোম্পানিটির জবাইখানায় এক দিনে ১০ হাজার মুরগি প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা রয়েছে।
তাদের মোট হ্যাচারির সংখ্যা ১৩টি। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির পোলট্রি ফিড কারখানা রয়েছে দুটি। কাজী ফার্মস ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। এতে কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা। আর গত বছরের ৩০ জুন শেষে কোম্পানিটির সংরক্ষিত মুনাফার পরিমাণ ১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা।থাইল্যান্ডভিত্তিক সিপি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি ফিড ও ডিম উৎপাদনের পাশাপাশি পোলট্রিভিত্তিক ফাস্টফুডের ব্যবসা করছে। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির বিক্রির পরিমাণ ৪ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। ওই সময়ে কোম্পানির কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয়েছে ১৫৩ কোটি টাকা। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষে সিপি বাংলাদেশের সংরক্ষিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭৮ কোটি টাকায়। প্যারাগন গ্রুপের প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেড ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৭০ কোটি
টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। ওই সময়ে কোম্পানির কর-পূর্ববর্তী মুনাফা হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। গত বছরের ৩০ জুন শেষে সংরক্ষিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২৭ কোটি টাকায়। সার্বিক বিষয়ে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি ও সিপি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ কল ধরেননি।সার্বিক বিষয়ে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন ঠিক থাকলেও সাম্প্রতিক বন্যায় কয়েকটি জেলার খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ৫০-৬০ লাখ পিস ডিমের উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে বাজারে কিছু সবজি আসতে দেরি হওয়ায় ডিমের চাহিদা বেড়ে গেছে। কোম্পানিগুলো নির্ধারিত দামেই বিক্রি করছে। সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করেও কোম্পানির লাভ থাকছে। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা বাড়তি দামের সুযোগটা নিচ্ছে। দেশে ডিম মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার সুযোগ নেই। ’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে মুরগির উৎপাদন ছিল ৩২ কোটি ৭৭ লাখ। এ সময়ে ডিমের উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি পিস। এতে বছরে মাথাপিছু ডিমের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩৫টি। তার পরও দাম বাড়ছে কেন? এ বিষয়ে খাত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি ডিম ও মাংসের বাজারের বড় অংশ হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির দখলে। এককভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা সারা দেশের ছোট-বড় খামারিদের কাছ থেকেও ডিম-মাংস সংগ্রহ ও বাজারজাত করে।তারা বলছেন, দেশের পোলট্রিপণ্যের বাজারের সিংহভাগই কাজী ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রির দখলে। বলতে গেলে বাজারের গতিপ্রকৃতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে মুনাফাও করেছে রেকর্ড পরিমাণে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে সিপি বাংলাদেশের সংরক্ষিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭৮ কোটি
টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাজী ফার্মস মুনাফা করেছে ১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে ৩২৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেড। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে পোলট্রি খাতের বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগ অনেক পুরনো। একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে ডিমের দাম বাড়ানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয় ডায়মন্ড এগ ও সিপি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ডায়মন্ড এগকে আড়াই কোটি টাকা ও সিপি বাংলাদেশকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি ও সিপি বাংলাদেশ ছাড়াও মুরগি, ডিম ও পোলট্রি খাদ্যের বাজারের বড় অংশের দখল রয়েছে নারিশ, আফতাব, কোয়ালিটি, প্রোভিটা, ডায়মন্ড এগ, রাশিক/জামান গ্রুপের। কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি ও সিপি বাংলাদেশের সর্বশেষ হিসাবে বছরে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬১ কোটি টাকা। ওই সময়ে
কোম্পানি তিনটির কর-পূর্ববর্তী মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬৬ কোটি টাকা। সংরক্ষিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৯১ কোটি টাকায়।