ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আহতদের দেখতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। সব আহতকে না দেখা এবং তাদের সঙ্গে কথা না বলার প্রতিবাদ জানিয়ে ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সড়ক অবরোধ করে নজিরবিহীন প্রতিবাদক রেছেন আহত রোগীরা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পেছনের পথ ধরে হাসপাতাল ছাড়ায় আহতদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ তিন উপদেষ্টাকে ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ার আল্টিমেটাম দেন। দুপুরে শুরু হওয়া এই আন্দোলন রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চলছিল। তাদের বিক্ষোভ থামাতে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ঘটনাস্থলে হাজির হলেও আহতদের রাস্তা থেকে হাসপাতালে ফেরাতে পারেন নি। যথাযথ চিকিৎসা মিলছে না এবং সরকারের তরফে খোঁজ নেয়া হয় না-এমন অভিযোগ তুলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে বিক্ষোভ দেখান শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাধীন আহতরা। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন পাশের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউশনে ভর্তি আহতরাও।গতকাল দুপুরে বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুককে সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। হাসপাতালে চতুর্থ তলায় ভর্তিদের দেখে নিচে নেমে যাওয়ায় তৃতীয় তলায় থাকা আহতরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা নিচে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন।এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়িতে কিল-ঘুষি মেরে গাড়ির উপরে ওঠে দাঁড়ায় একজন। কেউ আবার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে সারা কুক অন্য একটি গাড়িতে চেপে স্থান ত্যাগ করলেও আন্দোলনকারীদের রোষানলে পড়েন উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। পরে হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় উপদেষ্টা বিকল্প পথে হাসপাতাল ত্যাগ করলেও সামনের মূল সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন আহতরা।বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক ও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের জন্য হাসপাতালটির তিনতলা ও চারতলায় দুইটা আলাদা আলাদা ডেডিকেটেড ওয়ার্ড খোলা হলেও তারা শুধুমাত্র চতুর্থ তলার পুরুষ ওয়ার্ডের রোগীদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল ত্যাগ করতে চান। কিন্তু অপেক্ষারত তিনতলায় চিকিৎসাধীন জুলাই বিপ্লবের রোগীরা উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানাতে চান। এক পর্যায়ে রোগী ও তাদের স্বজনেরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে চলে আসেন। তখন গণমাধ্যমকর্মীরা উপদেষ্টাও সারাহ কুককে কিছু বলার অনুরোধ করে। কিন্তু তারা কথা না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আহতরা এগিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের কথাও শোনেনি। এক পর্যায়ে উপদেষ্টার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকারা আহতদেরসহ সকলকে পেছনের দিকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে নূরজাহান বেগমকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে যান। এতেই বিক্ষোভ শুরু করে হাসপাতালটিতে ভর্তি জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে আহত ও তাদের স্বজনরা। এসময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা আন্দোলনকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো কথা না শুনে বিক্ষুব্ধ জনতার কেউ কেউ গাড়ির জানালার কাঁচে কিল-ঘুষি মারা শুরু করেন। কেউ গাড়ির ওপরে উঠে দাঁড়ান। গাড়ির চালককেও বাইরে বেরিয়ে আসতে বলেন কেউ কেউ। উপদেষ্টার গাড়িকে ঘিরে যখন এতসব কাণ্ড তখন গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে অন্য গাড়িতে চেপে চলে যান নূরজাহান বেগম।হচ্ছে। আমাদের কী অন্য কোনো খরচ লাগে না? আমাদের পরিবার আমাদের পেছনে খরচ করতে করতে সব শেষ করে ফেলেছে। দেশের জন্য এত ত্যাগ করে আমরা কী পেলাম। আজ আমাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যারা সরকার গঠন করেছে তারা এখন আমাদেরকেই চিনে না। আমরা চাই তারা সবাই আমাদের সঙ্গে কথা বলুক। আমাদের জন্য ঘোষণা করা সেই এক লাখ টাকা দিক এবং যাদের যাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন তাদেরকে সেভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া হোক। ১৯শে জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ মো. শাহীন নামে আরেক জন বলেন, আজ পর্যন্ত আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। সেই কথাই বলতে গিয়েছিলাম উপদেষ্টাকে। নিজেদের মানুষ মনে করে তার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কথা তো শুনলেনই না উল্টো অপমান করলেন। আমরা দেশের জন্য নিজেকে বলি দিয়ে আজ চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব। আমরা এর প্রতিকার চাই। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে এসে বিক্ষোভে যোগ দেয়া গত ৪ই আগস্ট চোখে গুলিবিদ্ধ কিশোরগঞ্জ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী শেখ সাদী বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। আমি গত ৬ই আগস্ট থেকে চক্ষু বিজ্ঞানে ভর্তি। আমার ডান চোখে এখনো গুলি ঢুকে আছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আমরা সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট দিয়েছি।এদেশ থেকে আমার চোখের গুলি বের করা সম্ভব নয়। বিদেশে যেতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কোনো আলাপ করলো না। আমাদের শুধু ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এই ওষুধ ছাড়াও যে একটা রোগীর কতো খরচ লাগে সে হিসাব কেউ নেয় না। রোগীর সঙ্গে যেই স্বজনরা থাকে, তাদের খরচ কেউ দেয় না। এমনকি এক লাখ টাকা করে দেয়ার কথা তাও আমরা পাইনি। আমাদের অনুদানের টাকা পর্যন্ত মেরে খাওয়া হচ্ছে। আমরা এসবের প্রতিকার চাই। আমাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সকল দাবি পূরণ করতে হবে। রাত সাড়ে ৭টার দিকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আন্দোলনকারীরা স্নিগ্ধকে তাদের পাশে অবস্থান করার অনুরোধ করেন।ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জিয়াউল হক বলেন, আমরা দুপুর থেকে অনেকবার আহত আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাদেরকে বারবার রাস্তা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই তারা রাস্তা ছাড়তে রাজি হননি।