যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, চীন, সৌদি আরবসহ পূর্ব-পশ্চিমের ২১টি দেশ ও সংস্থায় রাষ্ট্রদূত পদমর্যাদায় প্রস্তাবিত নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দীর্ঘ ওই তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের অনেকের বিরুদ্ধে পেশাদারিত্বের সীমা লঙ্ঘন করে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত খায়-খাতির থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারি চাকরির পাশাপাশি গোপনে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন অবশ্য উত্থাপিত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। মানবজমিনের জিজ্ঞাসার জবাবে গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বলেন, প্রস্তাবিত দূতদের এগ্রিমো চাওয়া কিংবা পাওয়ার প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি গোপনীয়। সুতরাং এটি কোনো অবস্থাতেই প্রকাশ করা যাবে না যে কাকে কোথায় প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত স্পেকুলেশন চলবে- এটা ধরেই আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছি। ‘এগ্রিমো গেছে বা যায়নি’ এসব আলাপ পররাষ্ট্র সচিবের জন্য সমীচীন নয়। জসীম উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন লেভেলে দফায় দফায় আলোচনা এবং যাচাই-বাছাইয়ের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা স্থায়ী প্রতিনিধির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে কাউকে প্রস্তাব করা হয়। চূড়ান্ত নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত প্রস্তাবিত দূতের বিষয়ে রিপোর্ট সংগ্রহ চলতে থাকে। এগ্রিমো পাওয়ার পর নিয়োগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের ন্যূনতম সত্যতা পাওয়া গেলে অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যবস্থা নেয়, নিকট অতীতেই তার উদাহরণ রয়েছে। অন্য এক কর্মকর্তা দৃঢ়তার সঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, কিছু কিছু অভিযোগের যে সত্যতা রয়েছে, এ বিষয়ে খোদ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অবহিত। সচিব তো বটেই। কিন্তু ব্যক্তিগত এফিলিয়েশনের কারণে হয়তো তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তবে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, আন্তঃব্যাচ প্রতিযোগিতা এবং প্রফেশনাল জেলাসি থেকেও নিয়োগ-পদায়ন নিয়ে হরহামেশা প্রশ্ন এবং সমালোচনা হয় বলে মনে করেন ক্যারিয়ারের মাঝামাঝিতে অবস্থান করা ওই কর্মকর্তা।
কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের দায় এড়াতে পররাষ্ট্র সচিব প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা স্থায়ী প্রতিনিধিদের নাম মুখে না নিলেও সরকারের একাধিক বিশ্বাসযোগ্য সূত্র মানবজমিনকে এটা নিশ্চিত করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, বৃটেন, সৌদি আরবসহ আটটি দেশে এরইমধ্যে নতুন রাষ্ট্রদূতের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে হোস্ট কান্ট্রির সম্মতির জন্য প্রস্তাবিত দূতের বিস্তারিত পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া গত মাসে বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আরও ১২ দেশে নতুন দূত নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। তাছাড়া সেপ্টেম্বরেই সাবেক সচিব মো. মাহফুজুর রহমানকে পর্তুগালে রাষ্ট্রদূত করার নোটিশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এগ্রিমোপ্রাপ্তি সাপেক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার নিয়োগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিবে। সূত্র বলছে, যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে ভিয়েনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলমকে যুক্তরাষ্ট্রে, ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলামকে চীনে, মেক্সিকোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামকে বৃটেনে, রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলীকে জাপানে, দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম দেলোয়ার হোসেনকে সৌদি আরবে, আলজেরিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলকার নাইনকে জার্মানিতে, ফরেন সার্ভিস একাডেমির মহাপরিচালক শাহনাজ গাজীকে রোমানিয়ায় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মহাপরিচালক তারেক আহমদকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানোর জন্য হোস্ট কান্ট্রির সম্মতি চাওয়া হয়। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রস্তাবিত দূতকে গ্রহণে এরইমধ্যে অনাপত্তি জানিয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রাচার প্রধান খন্দকার মাসুদ আলমকে বেলজিয়াম ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (জাতিসংঘ অনুবিভাগ) তৌফিক হাসানকে অস্ট্রিয়ায়, মহাপরিচালক (আঞ্চলিক সংস্থা অনুবিভাগ) রইস হাসান সরওয়ারকে বাহরাইনে, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম এনডিসিকে ব্রাজিলে, নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদাকে ইরাকে, সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারীকে মেক্সিকোয়, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসাকে নেপালে, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও ঢাকা নৌ অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল খন্দকার মিসবাহ-উল-আজিমকে ওমানে, নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি তৌফিক ইসলাম শাতিলকে দক্ষিণ কোরিয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (মিয়ানমার অনুবিভাগ) ফেরদৌসী শাহরিয়ারকে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে।
তাছাড়া নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের পরবর্তী স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সালাহউদ্দীন নোমান চৌধুরীকে এবং ওআইসিতে নব প্রতিষ্ঠিত (আগে সৌদি আরবে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ওআইসিতে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন) স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে মিলানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল এমজেএইচ জাবেদকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত ২১ রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ চূড়ান্ত হলেও বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিল্লি মিশনে কাকে পাঠানো হবে? সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। পাশাপাশি রাশিয়ায়ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের পদ খালি। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, মালদ্বীপ ও আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রদূতের শূণ্য পদে নতুন নিয়োগ হবে। নেটিজেনদের উৎসাহ এবং… লন্ডনে বাংলাদেশের পরবর্তী হাই কমিশনার কে হচ্ছেন? তা নিয়ে অন্তহীন জল্পনা-কল্পনা। বৃটেনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি ডায়াসফেরায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ সব দলের ফেলো রয়েছেন। লন্ডন মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতার ঐতিহাসিক যোগসূত্র। সেই বিবেচনায়ও বৃটেনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিষয়ে ঢাকার বাড়তি মনোযোগ। রিপোর্টে প্রকাশ শেখ হাসিনার আমলে মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবিদ ইসলাম লন্ডনে পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে আওয়ামী প্রীতি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলছে।বাংলাদেশের স্বৈরশাসন নিয়ে সরব থাকা খ্যাতিমান সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীকে অন্তর্বর্তী সরকার সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় রাষ্ট্রদূত করার প্রজ্ঞাপন জারি করে। তাকে নিয়ে নেটিজেনদের উৎসাহ-উদ্দীপনা চরমে। শুধু তাই নয়, খোদ স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রিফিংয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়েছে। অতি সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নরের আটকাদেশ স্থগিত করতে স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি ভূমিকা রেখেছেন, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। অনেক মিডিয়া তাকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত বলে খবর প্রচার করে। তাকে লন্ডনে কিংবা কানাডায় পাঠানো হতে পারে বলেও আলোচনা রয়েছে। এইমধ্যে খবর বেরিয়েছে তাকে মেক্সিকোতে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রস্তাব করার। এটি হলে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় মেক্সিকোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পাঠানোর ঘটনা হবে এটাই প্রথম! উল্লেখ্য, ব্রাজিলে বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে এমন একজনকে প্রস্তাব করা হয়েছে যাকে ইউরোপের কোনো দেশ গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রদূত মো. তৌহিদুল ইসলাম এনডিসিকে সর্বশেষ অস্ট্রিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা ছিল। তার জন্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন যারপরনাই চেষ্টা করেছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙে তিনি অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে গোটা বাংলাদেশের ইজ্জত ধুলায় মিশিয়েছিলেন!